রাসুল (সাঃ)-এর চরিত্র ও গুনাবলী

সংক্ষেপে তার গুণাবলীঃ
যে ব্যক্তি খুবই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাসুল (সাঃ) এর দিকে তাকাবে সে দেখতে পাবে তার চরিত্র ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। কোন মানুষ তার সমকক্ষ হওয়া তো দুরের কথা তার কোন একটি গুণাবলীর সমানও হতে পারবে না। তাকে যিনি শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হলেন মহান প্রভু আল্লাহ্‌ তায়ালা।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন:أَدَّبَنِىْ رَبِّىْ فَأَحْسَنَ تَأْدِيْبِىْ
অর্থাৎ, আমার রব আমাকে সর্বোত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।(আল ফাওয়ায়েদুল জালিয়্যাহঃ ১/১০১; হাদীসটির অর্থ সহীহ; দেখুন- আত তাজকেরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহারাহঃ ১/১৬০, কাশফুল খিফাঃ ১/৮১, ১/৭০, আসনাল মাত্বালিবঃ১/৩৫; আবুল ফাজল বিন নাসির এটাকে সহীহ বলেছেন, আদ দুরারুল মুনতাসিরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহারাহঃ১/৪৫)

আল্লাহ্‌ তায়ালা এ সম্বন্ধে বলেন:وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ (4)
অর্থাৎ, আর নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা আল ক্বালামঃ ৪) কেন তিনি এ রকম হবেন না অথচ, তিনি মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার আশ্রয়ে দেখাশোনার মধ্যে ছিলেন।আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেছেন :   فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا   
অর্থাৎ, আর আপনি আমার চোখে চোখেই আছেন। (সুরা তুরঃ ৪৮)
অপরদিকে তিনি মুসা (আঃ) সম্বন্ধে বলেছেন:وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي
অর্থাৎ, আর [আমি চাই] তুমি যেন আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও। (সুরা ত্বাহা: ৩৯)

“চোখের সামনে রাখতে চাওয়া’ এবং “চোখে চোখে রাখা” এ দুইয়ের মধ্যে কতই না পার্থক্য!!!! এখান থেকেই তার সুমহান চরিত্রের বর্ণনা স্পষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক বড় মনীষীর ভিতরে তার সমপরিমাণ একটা গুণ পাওয়া যদি খুবই দুর্লভ হয়, তাহলে তার সবগুলো গুণাবলী তাদের মাঝে কিভাবে পাওয়া সম্ভব হবে???

রাসুল (সাঃ) এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যঃ

১। ধৈর্যঃ নিজেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বদা আল্লাহ্‌ তায়ালার আনুগত্যের উপর অটল রাখা, অবাধ্যতার নিকটবর্তী না হওয়া, তার সিদ্ধান্তের কারণে হা হুতাশ না করা এবং তাতে রাগান্বিত না হওয়ার নামই ধৈর্য।

রাসুল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করতে গিয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে অমানুষিকভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে ধৈর্যধারণ করেছেন। তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন দুঃখের বছর, যুদ্ধক্ষেত্র, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, ক্ষুধা ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে। কোন ষড়যন্ত্রই তাকে দুর্বল করতে পারেনি এবং কোন পক্ষই তাকে টলাতে পারেনি।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
هَلْ أَتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أَشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ، قَالَ: ” لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ مَا لَقِيتُ، وَكَانَ أَشَدَّ مَا لَقِيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ العَقَبَةِ، إِذْ عَرَضْتُ نَفْسِي عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ، فَلَمْ يُجِبْنِي إِلَى مَا أَرَدْتُ، فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي، فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلَّا وَأَنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ فَرَفَعْتُ رَأْسِي، فَإِذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلَّتْنِي، فَنَظَرْتُ فَإِذَا فِيهَا جِبْرِيلُ، فَنَادَانِي فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ، وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ، فَنَادَانِي مَلَكُ الجِبَالِ فَسَلَّمَ عَلَيَّ، ثُمَّ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ، فَقَالَ، ذَلِكَ فِيمَا شِئْتَ، إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللَّهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ وَحْدَهُ، لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا “

অর্থাৎ,আপনার কাছে কি এমন কোন দিন এসেছে যা উহুদের চেয়েও কঠিন দিন ছিল? রাসুল (সাঃ)বলেন:আমি তোমার কওম থেকে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি যা বর্ণনাতীত।আর আকাবার দিন(তায়েফের ঘটনা)ছিল তাদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে কঠিন অবস্থা!!আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম ইবনে আবদি ইয়ালিল ইবনে আব্দি কুলাল গোত্রের কাছে;কিন্তু,তারা আমার ইচ্ছায় সাড়া দিল না।অতঃপর আমি চেহারায় দুঃখের ছাপ নিয়ে ফিরে আসছিলাম।আমি যখন সম্বিত দিরে পেলাম তখন আমি ছিলাম-”ক্বারনে ছা’য়ালেব” নামক স্থানে।আমি মাথা উপরের দিকে তুললাম।দেখলাম একখন্ড মেঘ আমাকে ছায়া দিয়েছে।সেখানে জিবরাইল (আঃ)এর সাক্ষাত পেলাম।তিনি আমাকে ডেকে বললেন:আল্লাহ্ তায়ালা কওমের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য ও তাদের জবাব শুনেছেন।তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন।তাদের ব্যাপারে আপনার যা খুশি তাকে নির্দেশ দেবেন।পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডেকে সালাম দিয়ে বললেন,হে মুহাম্মাদ (সাঃ)!!আপনি যা চান তাই হবে।যদি আপনি বলেন তাহলে,আমি তাদের উপর পাহাড় দুটি চাপিয়ে দেব।রাসুল (সাঃ)বললেন:[না!!!]বরং,আমি চাই তাদের ঔরসজাত সন্তানদের মধ্য থেকে এমন কেউ বের হোক যে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদাত করবে তার সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে না।(বুখারী-৩২৩১,মুসলিম-১৭৯৫)

২।ক্ষমা করাঃ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেয়ার নামই ক্ষমা।মক্কা বিজয়ের দিনে রাসুল(সাঃ)মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন।তারা নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে তার নির্দেশেরই অপেক্ষা করছিল।তিনি বললেন:হে কুরাইশগণ !!!তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা কর? তারা বলল:সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মত!!!তিনি বললেন:তোমরা চলে যাও!!!আজ তোমরা মুক্ত!!!তারা তাকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন,তিরস্কার,সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।

৩।সাহসীকতাঃ কথাবার্তা,মতপ্রকাশ ও কোন কাজ করতে যাওয়ায় সাহসীকতা প্রদর্শন একটা অত্যন্ত চমৎকার গুণাবলী।রাসুল(সাঃ)যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন সকল মানুষের চেয়ে বেশী সাহসী।তার মত সাহসী মানুষ কোন চোখ দেখেনি।বীর সিপাহী হযরত আলী (রাঃ)বলেন:যখন প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হত তখন আমরা রাসুল (সাঃ)কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম।তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনায়ন যুদ্ধে। শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন:

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَشْجَعَ النَّاسِ» وَلَقَدْ فَزِعَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَانْطَلَقَ نَاسٌ قِبَلَ الصَّوْتِ، فَتَلَقَّاهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَاجِعًا، وَقَدْ سَبَقَهُمْ إِلَى الصَّوْتِ، وَهُوَ عَلَى فَرَسٍ لِأَبِي طَلْحَةَ عُرْيٍ، فِي عُنُقِهِ السَّيْفُ وَهُوَ يَقُولُ: «لَمْ تُرَاعُوا، لَمْ تُرَاعُوا» قَالَ: «وَجَدْنَاهُ بَحْرًا، أَوْ إِنَّهُ لَبَحْرٌ» قَالَ: وَكَانَ فَرَسًا يُبَطَّأُ

” রাসুল (সাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম ব্যক্তি, সর্বোচ্চ দানশীল, সবচেয়ে সাহসী। এক রাত্রে একটা শব্দের কারণে মদীনাবাসীরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা শব্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। রাসুল (সাঃ) ফিরে আসার পথে তাদের দেখা পেলেন। তিনি তাদের আগেই শব্দের কাছে চলে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আবু তালহার ঘোড়ায় এবং তার তার কাধে ঝুলছিল খোলা তরবারী। তিনি তাদেরকে বলছিলেন, অবস্থা শান্ত!! অবস্থা শান্ত!! [ক্ষতিকর কোন কিছুর সম্ভাবনা নেই]। তিনি বলেন: আমরা তাকে পেয়েছি সমুদ্রের মত অথবা তিনি ছিলেন সমুদ্র [সমুদ্রের বেগে এগিয়ে যেতেন]। তিনি বলেন: ঘোড়াটিও ছিল খুবই ধীরগতিসম্পন্ন।(মুসলিম-২৩০৭, ইবনে মাজাহ-২৭৭২, মুসনাদে আহমাদ-১৩৮৬৫, সহীহ ইবনে হিব্বান-৬৩৬৯,বায়হাকীঃ সুনানুল কুবরা-১৮৫৬০)

৪। সহনশীলতাঃ আর তা হল নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা; ব্যক্তির কথা কিংবা কাজ থেকে অপছন্দনীয় কোন কিছু যেন পাওয়া না যায়। এরই নাম সহনশীলতা।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:

أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِي المَسْجِدِ، فَثَارَ إِلَيْهِ النَّاسُ ليَقَعُوا بِهِ، فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «دَعُوهُ، وَأَهْرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ، أَوْ سَجْلًا مِنْ مَاءٍ، فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ»
অর্থাৎ, একজন বেদুঈন মসজিদে পেশাব করেছিল। লোকেরা তার উপরে হামলে পড়ার জন্য ফুসে উঠলে রাসুল (সাঃ) তাদেরকে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও!! আর তার পেশাবের উপর বালতি ভর্তি পানি অথবা বালতি দিয়ে পানি ঢেলে দাও। কেননা, তোমরা সহজ করার জন্য প্রেরিত হয়েছো, কঠিন করার জন্য প্রেরিত হওনি। (বুখারী-৬১২৮, সহীহ ইবনে হিব্বান-১৪০০)

অন্য হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَاعِدًا فِي الْمَسْجِدِ وَأَصْحَابُهُ مَعَهُ، إِذْ جَاءَ أَعْرَابِيٌّ فَبَالَ فِي الْمَسْجِدِ، فَقَالَ أَصْحَابُهُ: مَهْ مَهْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَا تُزْرِمُوهُ دَعُوهُ “، ثُمَّ دَعَاهُ فَقَالَ لَهُ: ” إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنَ الْقَذَرِ وَالْبَوْلِ وَالْخَلَاءِ “، أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّمَا هِيَ لِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ وَذِكْرِ اللهِ وَالصَّلَاةِ “. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ مِنَ الْقَوْمِ: ” قُمْ فَأْتِنَا بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ، فَشُنَّهُ عَلَيْهِ ” فَأَتَاهُ بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَشَنَّهُ عَلَيْهِ
অর্থাৎ, হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসুল (সাঃ) একবার সাহাবীদের সাথে মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে সেখানে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবীরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। রাসুল (সাঃ) বললেন: তাকে ছেড়ে দাও; বাধা সৃষ্টি করো না [পেশাবে বাধা সৃষ্টি করলে বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে]। তারপর তিনি তাকে ডেকে বললেন: এগুলো মসজিদ; এস্থান অপবিত্রতা কিংবা পেশাব পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়। অথবা তিনি বলেছেন: সেটা কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিকির ও নামাজের স্থান। অতঃপর রাসুল (সাঃ) কওমের একজন লোককে বললেন, তুমি পানি ভর্তি একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর এর উপর ঢেলে দাও। তিনি বালতিতে পানি এনে তার উপর ঢেলে দিলেন। (মুসনাদে আহমাদ- ১২৯৮৪; হাদীসটি সহীহ)

৫।দানশীলতাঃ মুহাম্মাদ(সাঃ)এর দানশীলতা ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী।তিনি নিজের কাছে কিছু থাকলে কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না।তিনি একসময় ইয়েমেনী একসেট পোশাক পরেছিলেন।একজন এসে পোশাকটা চাইলে তিনি বাড়ীতে গিয়ে সেটা খুলে ফেললেন।এরপর সেটা লোকটির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।তার কাছে কেউ কিছু চাইলেই তিনি তা দিয়ে দিতেন।একবার একজন লোক তার কাছে এসে ছাগল চাইলে তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ ছাগল দিয়েছিলেন।যা দুই পাহাড়ের মধ্যকার স্থান পূর্ণ করে ফেলবে।এরপর লোকটা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বলল:হে আমার সম্প্রদায়!!! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর।আল্লাহর কসম!!মুহাম্মাদ(সাঃ)এত বেশী পরিমাণে দান করেন যে কখনও দারিদ্রতার ভয় করেন না।

মুসলিম শরীফে এসেছে:
عَنْ مُوسَى بْنِ أَنَسٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: ” مَا سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْإِسْلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ، قَالَ: فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ، فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ، فَقَالَ: يَا قَوْمِ أَسْلِمُوا، فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِي عَطَاءً لَا يَخْشَى الْفَاقَةَ
অর্থাৎ,হযরত মুসা বিন আনাস (রাঃ)হতে বর্ণিত,তিনি তার পিতার সুত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল(সাঃ)এর ক্ষেত্রে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি যে,কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে অথচ,তিনি তা দেননি।তিনি বলেন:একবার তার কাছে একজন লোক আসলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মাঝের ছাগল [এত বেশী পরিমাণ ছাগল দিয়ে দিলেন যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পরিপূর্ণ করে দেবে]দিয়ে দিলেন।অতঃপর লোকটি নিজের সম্প্রদায়কে বলল:হে আমার সম্প্রদায়!!তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর।কেননা,মুহাম্মদ (সাঃ)এত বেশী পরিমাণে দান করছেন যে তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কোন ভয় করেন না।(মুসলিম শরীফ-২৩১২)

হযরত আনাস(রাঃ)বলেন,লোকটি রাসুল(সাঃ)এর কাছে শুধুমাত্র দুনিয়াবী স্বার্থের জন্যই এসেছিল।কিন্তু,সন্ধাবেলা এমন অবস্থার সৃষ্টি হল যে,রাসুল (সাঃ)এর আনীত দ্বীন উক্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ও তার মধ্যকার সমস্ত জিনিসের চেয়ে বেশী প্রিয় ও সম্মানিত বলে গণ্য হল।(মুসনাদে আহমাদ-১৪০২৯;হাদীসটি সহীহ)

৬।ন্যায়বিচারঃ রাসুল(সাঃ)এর ন্যায় বিচারের অনেক প্রমাণ রয়েছে।তন্মধ্যে এখানে মাখজুমী গোত্রের একজন মহিলার ঘটনা উল্লেখ করব।চুরির কারণে তার উপর শাস্তিস্বরূপ হাত কাটার বিধান বাস্তবায়ন করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।কেননা,মহিলা ছিল উচ্চ বংশীয় লোক।সাহাবীগণ তার ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য রাসুল(সাঃ)এর কাছে তার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হযরত উসামা(রাঃ)কে পাঠিয়ে দিলেন।

তিনি সুপারিশ করলে রাসুল(সাঃ)তাকে বলেছিলেন:
أَتَشْفَعُ فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ» ثُمَّ قَامَ فَخَطَبَ، قَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّمَا ضَلَّ مَنْ قَبْلَكُمْ، أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ الضَّعِيفُ فِيهِمْ أَقَامُوا عَلَيْهِ الحَدَّ، وَايْمُ اللَّهِ، لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، سَرَقَتْ لَقَطَعَ مُحَمَّدٌ يَدَهَا»
অর্থাৎ,তুমি কি আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত করে দেয়া শাস্তি সম্বন্ধে সুপারিশ করছো???!!! তারপর তিনি বক্তৃতা করলেন।বক্তৃতায় বললেন:হে মানষেরা!!তোমাদের পুর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়ে গেছে।তারা সম্মানী বংশের কেউ চুরি করলে তাদেরকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বলেরা চুরি করলে তাদের উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম!!! যদি মুহাম্মাদ (সাঃ)এর মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত,তবুও মুহাম্মাদ(সাঃ)তার হাত কেটে দিতেন।(বুখারী-৬৭৮৮,একই অর্থে ৪৩০৪,৩৪৭৫, মুসলিম-১৬৮৮,আবু দাউদ-৪৩৭৩, তিরমীজি-১৪৩০, নাসায়ী-৪৮৯৯,৪৯০২, ইবনে মাজাহ-২৫৪৭, দারেমী-২৩৪৮, সহীহ ইবনে হিব্বান-৪৪০২, বায়হাকীঃ সুনানুস সাগীর-২৬৪৩, বায়হাকীঃ সুনানুল কাবির-১৭১৫৫)

৭।লজ্জাশীলতাঃ হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ)বলেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ العَذْرَاءِ فِي خِدْرِهَا، فَإِذَا رَأَى شَيْئًا يَكْرَهُهُ عَرَفْنَاهُ فِي وَجْهِهِ»
অর্থাৎ, ঘরের ভিতরে অবস্থানকারিনী কুমারী মেয়ের চেয়েও রাসুল(সাঃ) বেশী লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কোন কিছু দেখে অপছন্দ করতেন তখন তার চেহারা দেখেই আমরা বুঝতে পারতাম। (বুখারী-৬১০২, ৩৫৬২, ৬১১৯, মুসলিম-২৩২০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-২৫৩৪৬, মুসনাদে আহমাদ-১১৬৮৩,১১৮৬২, সহীহ ইবনে হিব্বান-৬৩০৮, বায়হাকীঃ সুনানুল কুবরা-২০৭৮৬)

৮। দোষ ঘোষণা না করাঃ হযরত আয়েশা(রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) এর কাছে কোন ব্যক্তির অপছন্দনীয় কোন কাজের সংবাদ আসলে তিনি বলতেন না, অমুকের কি হল যে এমন কথা বলছে? বরং বলতেন: কওমের কি হয়েছে যে, তারা এমন এমন কাজ করে কিংবা এমন এমন কথা বলে? তিনি নিষেধ করতেন কিন্তু, কে দোষের কাজটি করেছে তার নাম নিতেন না। (উয়ুনুল আসারঃ ২/৩৯৯)

৯। দুনিয়া বিমুখীতাঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:

نَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حَصِيرٍ فَقَامَ وَقَدْ أَثَّرَ فِي جَنْبِهِ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوِ اتَّخَذْنَا لَكَ وِطَاءً، فَقَالَ: «مَا لِي وَلِلدُّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا

অর্থাৎ, রাসুল (সাঃ) নলখাগড়া জাতীয় গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন। এতে তার শরীরে দাগ হয়ে গেলে আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)!! আমরা আপনার জন্য ভাল কোন বিছানার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। অতঃপর রাসুল (সাঃ) বললেন: আমার দুনিয়ার প্রতি কোন আকর্ষণ নেই। আমি দুনিয়াতে একজন পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে চলে যায়। (তিরমীজি-২৩৭৭; হাদীসটি সহীহ)

১০। উত্তম সঙ্গঃ হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
خَدَمْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ سِنِينَ، وَاللهِ مَا قَالَ لِي: أُفًّا قَطُّ، وَلَا قَالَ لِي لِشَيْءٍ: لِمَ فَعَلْتَ كَذَا؟ وَهَلَّا فَعَلْتَ كَذَا؟
অর্থাৎ, আমি রাসুল (সাঃ) কে দশ বছর সেবা করেছি। আল্লাহর কসম!! তিনি আমাকে কখনও উফ [ধমক বাচক শব্দ] পর্যন্ত বলেননি। আর তিনি আমাকে কোন কাজের জন্য বলেননি কেন এমন করলে এবং এমন কেন করলে না? (মুসলিম-২৩০৯, দারেমী-৬৩, একই অর্থেঃ সহীহ ইবনে হিব্বান-২৮৯৩, ২৮৯৪)

১১। নম্রতাঃ রাসুল (সাঃ) যখন মক্কা বিজয় করে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করছিলেন তখন আল্লাহ্‌ তায়ালার সামনে বিনম্রতায় এতটাই অবনত হয়েছিলেন যে তার দাড়ি তার বাহন উটটির চুটকে স্পর্শ করার উপক্রম হয়েছিল। অথচ, তখন তিনি ছিলেন এমনই এক পরিস্থিতিতে যখন অধিকাংশ রাজা বাদশাহ ও মণীষী স্বভাবতই অহংকার করে থাকে।