করোনাভাইরাস ( কোভিড-১৯ )
এই রোগটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO ) Pandemic বা বিশ্ব মহামারি হিসাবে ঘোষণা করেছে। করোনাভাইরাস এমন একটি ভাইরাস -যা এর আগে কখনো কোন মানুষের হয়নি।এবং বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে,এ রোগের কারণে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে এ ধরণের মহামারী দেখা দিলে আমাদের করণীয় কি এ বিষয়ে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৪০০ বছর আগেই বলে গিয়েছেন। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা পেশ করা হলো।
মহামারী দেখা দিলে ইসলাম কি বলে
উসামাহ্ ইবনু যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ত্ব‘ঊন বা মহামারী হলো এক রকমের ‘আযাব। এ ত্বা‘ঊন বানী ইসরাঈলের একটি দলের ওপর নিপতিত হয়েছিল। অথবা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপর নিপতিত হয়েছিল। তাই তোমরা কোন জায়গায় ত্বা‘ঊন (মহামারী)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে শুনলে সেখানে যাবে না। আবার তোমরা যেখানে থাকো, মহামারী শুরু হয়ে গেলে সেখান থেকে পালিয়ে বের হয়ে যেও না। (বুখারী, মুসলিম)
আল্লাহ্র রাসূল (সঃ) অন্যত্র বলেছেন-
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগ-মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে সেখানে যাবে না। আর যদি কোনো এলাকায় মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং তোমরাও সেখানে অবস্থান করো, তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে এসো না। (সুনান আবূ দাউদ)
মহামারী এলাকায় ধৈর্যধারণ করে অবস্থান করার ফজিলত
আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মহামারীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি আমাকে বললেন,এটা এক রকম ‘আযাব। আল্লাহ যার উপর চান এ ‘আযাব পাঠান। কিন্তু মু’মিনদের জন্য তা তিনি রহমাত হিসেবে গণ্য করেছেন। তোমাদের যে কোন লোক মহামারী কবলিত এলাকায় সাওয়াবের আশায় সবরের সাথে অবস্থান করে এবং আস্থা রাখে যে,আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তাই হবে, তাছাড়া আর কিছু হবে না, তার জন্য রয়েছে শাহীদের সাওয়াব। (বুখারী)
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ত্বা‘ঊন (মহামারী)’র কারণে মৃত্যু মুসলিমদের জন্য শাহাদাতের মর্যাদা। (বুখারী, মুসলিম)
আবূ হূরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যকার কাকে তোমরা শহীদ বলে মনে কর? সাহাবীগণ সমস্বরে বলে উঠল, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয়, সেই শহীদ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তাহলে তো আমার উম্মাতের মধ্যে শাহীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করে, সে শহীদ; যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিয়োজিত থেকে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে সেও শহীদ এবং যে ব্যক্তি প্লেগরোগে মৃত্যুবরণ করে, সেও শহীদ। আর যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করে, সেও শহীদ। (মুসলিম)
উপরে উল্লেখিত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম যদি কোন অঞ্চল মহামারীতে আক্রান্ত হয় সেখানকার লোক সেখান থেকে বের হবে না এবং অন্যরা সেখানে প্রবেশ করবে না। এবং অবশ্যই আক্রান্তগ্রস্ত এলাকা থেকে না পালিয়ে সেখানেই অবস্থান করা।কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যে দেশগুলো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আমাদের প্রবাসী ভাই ও বোনেরা সেখানে অবস্থান না করে দেশে ফিরে আসছেন এবং এসেই এয়ারপোর্ট এ আত্মীয়স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করছেন ,সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কোয়ারেন্টাইন বা হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না, আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন, আত্মীয় স্বজনরা তাদের বাড়িতে দেখা করতে আসছেন, প্রবাসীরা পাবলিক প্লেসে সাধারন ভাবেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন কেউ বা আবার করোনা ভাইরাস এ আক্রান্ত হওয়ার কথা শোনার পর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন।এ ভাবে আমাদের অজান্তেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। একবার কি ভেবে দেখিছি? আমাদের অসাবধনতার কারণে সর্ব প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের পরিবার,আত্বীয়স্বজন, সমাজ তারপর রাষ্ট্র।
আমরা যদি সেই আক্রান্ত স্থানে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে অবস্থান করতাম , ধৈর্যধারণ করতাম এবং এর ফলে তাক্বদীর অনুযায়ী আমাদের মৃত্যু হত তাহলে আল্লাহ্র রাসূল (সঃ) এর হাদিস অনুযায়ী শহীদি মৃত্যু নসীব হত।
তাই এখনো যদি আমাদের মধ্যে কারো করোনা ভাইরাসের উপসর্গ (জ্বর, সর্দি,শুকনো কাশি,শ্বাস কষ্ট ,গলা ব্যথা ইত্যাদি) দেখা দেয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার এর পরামর্শ গ্রহন করা এবং সেলফ্ কোয়ারেন্টাইন এ চলে যাওয়া।যাতে ভাইরাসটি আপনার দ্বারা সংক্রমিত হতে না পারে।
মহামারী দেখা দিলে আমাদের করণীয় আমল সমূহ
১. হতাশ না হয়ে মহান আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের উপর ধৈর্যধারণ করা,কেননা রোগ-মহামারী কিংবা দুর্যোগ- বান্দাদের পরীক্ষা করতে বিভিন্ন সময় আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আসে (সূরা বাকারা : ১৫৫)।
২.আক্রান্ত এলাকা থেকে বের না হওয়া বা প্রবেশ না করা।
৩. সংক্রামক ব্যাধিমুক্ত থাকতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা । পারলে সব সময় অযু অবস্থায় থাকা। যারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, পবিত্র জীবন যাপন করে, আল্লাহ তাআলা তাদের ভালোবাসেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২২২)
৪. বেশি বেশি ইস্তিগফার করা। কেননা যারা ইস্তিগফার করে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তাদের উপর আযাব পাঠান না। যেমনঃ আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন বলেছেন-তিনি এরূপ নন যে,তাদের ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। (আল-আনফালঃ ৩৩)
৫. এই দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করাঃ-
لَا حَوْلَ وَ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللَّه الْعَلِىِّ الْعَظِيْم
উচ্চারণ : ‘লা হাউলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।’
অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই, কোনো ভরসা নেই, যিনি মহান ও সর্বশক্তিমান।’
৬.বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা।
৭. বিশেষ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া আর তাহলো-
-اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল জুনূনি ওয়াল জুঝুামি ওয়া মিং সায়্যিয়িল আসক্ব-ম।’(আবু দাউদ,তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ,মাতাল হয়ে যাওয়া,কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে এবং আর দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানিনা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।
৮.নিম্নক্তো দোয়া বিকেলে (আছরের পরে) তিন বার পড়া-
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللّٰهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণঃ আঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত্তা-ম্মা-তি মিং শার্রি মা খলাক্ব। ”
অর্থঃ আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীর অসীলায় তিনি যা সৃষ্টি করেছেন,তার মন্দ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সহিহ মুসলিম)
৯. নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করাঃ-
اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউঝুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি,ওয়াল আদওয়ায়ি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই। (তিরমিজি)
১০. যে ব্যক্তি সকালে তিনবার (ফজর এর ছলাতের পর) এবং বিকালে (আসরের ছলাতের) পর নিমক্ত দোয়াটি তিনবার বলবে, তাহলে আকাশ এবং জমিনের মাঝে কোনো কিছুই তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।
بِسْمِ اللّٰهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ : (বিস্মিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদ্বুররু মা‘আ ইস্মিহী শাইউন ফিল্ আরদ্বি ওয়ালা ফিস্ সামা-ই, ওয়াহুয়াস্ সামী‘উল ‘আলীম)।
অর্থঃ “আল্লাহ্র নামে; যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।” [আবূ দাউদ,তিরমিযী, ইবন মাজাহ]
১১. বাড়িতে বা ঘরে প্রবেশ এর সময় সালাম দেয়া।
১২. খাবার এর শুরুতে – بِسْمِ اللّٰهِ বলা।
১৩. ডাক্তাররা যে পরামর্শ দিয়েছে সেগুলো পালন করা।যেমনঃ বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করা, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, বাহিরে গেলে ম্যাস্ক ব্যবহার করা।
১৪. সূরা ফাতিহা ৭ বার পড়ে ফুঁ দেয়া।
১৫. সূরা ইখলাস (কূল হূওয়াল্ল-হু আহাদ্),সূরা ফালাক্ব (কূল আউজু বিরব্বিল ফালাক্ব),সূরা না-স (কূল আউজু বিরব্বিন না-স) এই তিনটি সূরা প্রত্যেক ফরজ ছলাতের পর পাঠ করা এবং ফজর ও মাগরীবের ছলাতের পর এই তিনটি সূরা পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে সম্পূর্ণ শরীর মুছে দেওয়া।
১৬.মসজিদে মসজিদে ফরয ছলাতের শেষ রাকাতে ক্বুনুতে নাযেলা পড়া।
১৭. যে কোন রোগাক্রান্ত রোগিকে দেখতে গেলে নিম্নোক্ত দোয়াটি সাত বার পাঠ করা।
أَسْأَلُ اللّٰهَ الْعَظيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ
উচ্চারণঃ আসআলুল্লা-হাল ‘আযীম, রব্বাল ‘আরশিল ‘আযীম, আঁই ইয়াশফিয়াক।
অর্থঃ “আমি মহান আল্লাহ্র কাছে চাচ্ছি, যিনি মহান আরশের রব, তিনি যেন আপনাকে রোগমুক্তি প্রদান করেন।”
উচ্চারণঃ লা – ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায-যা-লিমীন।
অর্থঃ আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র-মহান, নিশ্চয় আমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত।
গূরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
১. কেউ কোন প্রকার গুজব ছড়াবেন না এ কাজটি ইসলামে মারাত্বক গুনাহের কাজ।
২.অহেতুক দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়াবেন না।
৩. কোন তথ্য সত্য বলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করবেন না।