লাইলাতুল কদর

লাইলাতুল কদর

‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ ও ভাগ্য নিরূপণ। ‘কদর’ থেকেই ‘তাকদির’ শব্দ। অবশ্য কদর শব্দের অন্য অর্থ সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে  মহিমান্বিত রজনী, সম্মানিত রাত্রি, ভাগ্য নিরূপণ, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ রজনী অর্থে সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

 আমাদের দেশে “শবে বরাত ” কে ভাগ্য রজনী বলা হয়ে থাকে অথছ এর প্রমাণ কুরআন ও সহীহ্‌ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। মূলত শবে কদর ই হচ্ছে ভাগ্য রজনী যা কুরআনুল কারীমের অসংখ্য আয়াত ও সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত।

লাইলাতুল কদর এর ফজিলত

মুমিন বান্দাদের জন্য লাইলাতুল কদর অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ ও বরকতময় রাত।এ রাতের ফজিলত বর্ণণা আল্লাহ সুব্‌হানয়াহু ওয়া তায়ালা নিজেই করেছেন।

إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ – وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ – لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ- تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ – سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ

 

অর্থঃ
১। নিশ্চই আমি কুরআন নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে

২। আর আপনি (মহাম্মাদ (সঃ) জানেন কি  ‘লাইলাতুল কদর’ কি

৩। লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

৪। সে রাতে ফিরিশ্তাগণ ও রূহ্ নাযিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে।

৫। শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।

(সূরা আল-ক্বদর, আয়াত: ১-৫)

ক্বদরের রাত অত্যাধিক সম্মানিত ও মহত্বপূর্ণ রাত, এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা এ বছর যা কিছু হবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন  সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩-৮ আয়াতে বলেন-

﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤ أَمۡرٗا مِّنۡ عِندِنَآۚ إِنَّا كُنَّا مُرۡسِلِينَ ٥ رَحۡمَةٗ مِّن رَّبِّكَۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦ رَبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَآۖ إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ ٧ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ رَبُّكُمۡ وَرَبُّ ءَابَآئِكُمُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٨ ﴾ [الدخان: ٣،  ٨]

অর্থঃ “নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে; নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়, আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, নিশ্চয়ই আমরা রাসূল প্রেরণকারী। তোমার রবের রহমতস্বরূপ; নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ– আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্ নেই, তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান; তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদেরও রব।” (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩-৮)

আল্লাহর রাসূল (সঃ) লাইলাতুল কদর এর ফজিলত সম্পর্কে বলেন,

 আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»

অর্থঃ ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় ক্বদরের রাতে দণ্ডায়মান থাকবে (ইবাদত করবে), তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
[বুখারী: ১৯০১; মুসলিম: ৭৬০]

ক্বদরের রাত কখন

ক্বদরের রাত অবশ্যই রমাদানের  শেষ দশ রাতে রয়েছে। কারণ, রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ)

«تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ»

অর্থঃ তোমরা রমাদানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করো। [বুখারী: ২০২০; মুসলিম: ১১৬৯]

আর শবে কদর জোড় রাত্রিগুলোর চেয়ে বেজোড় রাত্রিগুলোর মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي الوِتْرِ، مِنَ العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ»

অর্থঃ তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লইলাতুল ক্বদর অম্বেষণ করো। [বুখারী: ২০১৭]

শবে কদর এর আমল

১.হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; তুমি বলবে,

اَلَّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى

উচ্চারণঃ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন, তুহিব্বুল আ’ফওয়া; ফা’ফু আন্নি।’

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ-আলবানি)

২। যেহেতু এই রাত কুরআন নাযিলের রাত তাই এ রাতে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা।

৩। এই সম্মানিত রাত হচ্ছে ক্ষমার রাত তাই এ রাত্রে বেশি বেশি ইছতিগফার করা।

৪। লাইলাতুল কদর হচ্ছে ভাগ্য রজনী তাই এ রাত্রে বেশি বেশি দু’আ করা।আল্লহর নিকট জান্নাত চাওয়া জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া।

৫। ছলাত হচ্ছে আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। তাই  এ রাত্রে বেশি বেশি নফল ছলাত আদায় করা। বিশেষভাবে ছলাতুত তারবীহ্‌ এবং ছলাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করা।

৭। এই রাত্রে কোন ধরনের গুনাহের কাজে লিপ্ত না হওয়া এবং অনর্থক কাজে সময় নষ্ট না করা যেমনঃ ফেসবুক ,টুইটার,ইউটিউব, টিভিতে কিছু গুনাহের কিছু দেখা বা শুনা।

শেষ দশকে ই'তিকাফ করা

ই‘তিকাফ রমযানের শেষ ১০ দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ১০ দিনে মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।

আর ই‘তিকাফ হলো, আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য পার্থিব কাজ থেকে অবসর হয়ে মসজিদে অবস্থান করা। ই‘তিকাফ করা সুন্নাত, যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

অর্থঃ ‘তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মেলা-মেশা করো না।’ (সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৭)

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ করতেন সাহাবাগণও ই‘তিকাফ করতেন।

আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর বললেন,

« إِنِّى اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِى إِنَّهَا فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ».

অর্থঃ ‘আমি প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করে এ মহান রাতটি খুঁজলাম, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলাম, কিন্তু তাতে কদর নামক রাতটি পেলাম না। এরপর আমাকে বলা হলো, এ রাতটি শেষ ১০ দিনের মাঝে নিহেত রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই ই‘তিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে।’ [মুসলিম: ১১৬৭]

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত,

كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِه.

অর্থঃ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ ১০ দিনে ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করতেন।’ [বুখারী: ২০২৬; মুসলিম: ১১৭২]

সহীহ বুখারীতে ‘আয়েশা ছিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরও বর্ণিত,

كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا.

অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমযানে ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। আর তিনি যে বছর মারা যান, সে বছর ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। [বুখারী: ২০৪৪]

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত,

كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ فَلَمْ يَعْتَكِفْ عَامًا فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ لَيْلَةً.

অর্থঃ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন, পুরো বছর আর কোনো ই‘তিকাফ করতেন না। পরবর্তী বছর রমযানে ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।’

[তিরমিযী: ৮০৩; ইবন মাজাহ: ১৭৭০; ইবন খুযাইমাহ: ৩/৩৪৬]

ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন, “আমি জানি না কোনো আলেম দ্বিমত করেছেন কি না যে: ই‘তিকাফ সুন্নাত।”

সংগৃহীতঃ শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)