ভুমিকাঃ
إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين أما بعد
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট যিনি আমাদেরকে কুরআন হাদিসের আলোকে জীবন যাপনের তাওফিক দিয়েছেন। দুনিয়াতে এমন কোন কর্ম নাই যার বিধান ইসলামে উল্লেখ হয়নি। আমরা আজকে জানবো কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা বাণিজ্য করলে ইহকালীন জীবন কল্যানময় হয় এবং পরকালীন জীবন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
أَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
অর্থঃ ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন’। (বাক্বারাহ ২৭৫)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসাবে হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও এর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই অন্যায়, যুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মওজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।
আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন। হালালভাবে ব্যবসার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করতে পারি। অথচ আমরা ব্যবসার মাধ্যমে মানুষকে ঠকিয়ে/ ধোঁকা দিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অসন্তুস্টি অর্জন করছি । শুধু তাই নয় মানবজাতির অভিশাপ,ঘৃনা ও অসন্তুস্টি নিয়ে আমাদের জীবনকে কুলশিত করছি কারন এটা হক্কুল এবাদ তথা বান্দার হক। যেমন ধরুন কোন এক ক্রেতা আপনার কাছ থেকে কিছু পন্য ক্রয় করলো , আপনি তাকে ভাল পন্য বলে খারাপ পন্য দিলেন বা মাপে কম দিলেন , লোকটি পন্য নিয়ে চলে গেলেন হয়তো বা আপনার আর কোনো দিন দেখা হলো না আপনি যদি আপনার নিজের ভুল বুঝার পরে তার কাছে ক্ষমা চাইতে চান তখন কিন্তু আপনি আর তাকে খুজে পাচেছন না, এরকম অসংখ্য ক্রেতাকে ঠকিয়েছেন যাদেরকে আপনি আর খুজে পাবেন না। কিন্তু আপনিতো তাদের কাছে চির ঋনী হয়ে থাকলেন, কেয়ামতের দিন এই ঋন আপনাকে নিঃস্ব করে ফেলবে।
এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে;
عن ابى هريرة رضي الله ان رسول الله صلى الله عليه وصلم قال اَتَدْرُوْنَ مَا لْمُفْلِسُ قَالُوْا الْمُفْلِسُ قِيْنَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ اِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ اُمَّتِىْ مَنْ يَأْةِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بصَّلَوةٍ وَّصِيَامٍ وَزَكَاَةٍ وَّيَأْتِىْ قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَف هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَ سَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ اَنْ يَقْضَى مَا عَلَيْهِ اُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِمْ … طُرِحَ فِى النَّار
অর্থঃ আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে সলাত, সিয়াম, যাকাত আদায় করে আসবে এবং সাথে সাথে সেই লোকেরাও আসবে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হক্বদারকে তার নেকী দেয়া হবে। আবার ঐ হকদারকেও (পূর্বোক্ত হক্বদার যার উপর যুলুম করেছিল) তার নেকী দেয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার (প্রথমতো ব্যক্তির) নেকী শেষ হয়ে যায় তবে তাদের (পরের হক্বদারের) গুণাহসমূহ ঐ ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম: ৬৪৭৩)
আমরা অনেকেই হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হকের ব্যাপারে সচেতন কিন্তু হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের ব্যাপারে গাফেল। যেমন; লেনদেনে ধোঁকা, বাটপারি, ছিটারি করা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, কথার অভিশাপ দেওয়া, কথার খোটা বা গালি-গালাজ করা, হিংসা বা নিন্দা করা, হেয় মনে করে, মিথ্যা কথা বলা, কারো প্রতি মিথ্যারোপ করা, অন্যের ছবি বিকৃত করা, অন্যের ক্ষতি করা, কাউকে ধোঁকা দেয়া, কারো সাথে প্রতারনা করা, অন্যের অর্থের লোভ করা, গীবত বা পরচর্চা করা, শত্রূতামী করা,যাতায়াত পথে কারো সাথে খারাপ আচরণ করা যেমন বাসে কারো সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়া,বাসের হেল্পারদের সাথে, মা বোনদের সাথে খারাপ আচরণ করা,প্রতিবেশির সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়া তাদের প্রতি জুলুম করা, রাস্তার মাঝে এমন কিছু ফেলে রাখা যাতে মানুষের কষ্ট হয়, মসজিদে ঢুকে মানুষকে কষ্ট দিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া, সরকারি সম্পদ লুটে খাওয়া ,সরকারি সম্পদের মালিক কিন্তু দেশের সমস্ত জনগণ সুতরাং সরকারি সম্পদ ভক্ষন করা মানে সমস্ত জনগনের সম্পদ খাওয়া, যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের সমস্ত জনগণ ক্ষমা না করবে ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ মানুষ মানুষের সাথে সম্পর্কিত যা কিছু আছে তার হক রক্ষা করা বা আদায় করার নামই হলো হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক।আর বান্দার হক নষ্ট করলে প্রথমে বান্দার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে সে যদি ক্ষমা করে তখন আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মানুষের জীবনে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যাবতীয় কার্যকলাপ, আচার-আচরণ বিধি সবই মানুষ মানুষকে কেন্দ্র করে ঘটে থাকে। আল্লাহর ইবাদত (যেমন: সলাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি) ছাড়া বাকি সব যা মানুষকে কেন্দ্র করে ঘটে। কত বড় চিন্তার বিষয় ভাবতে পারেন হে মূমিন! মূসলীম!
সুদ হারামঃ
সুদ গ্রহণ, সুদ প্রদান উভয়ই লানতপ্রাপ্ত গোনাহ। তাই এ ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা জায়েজ নয়। হারাম। হারাম টাকায় ব্যবসাকৃত সম্পদও হারাম হবে। তাই এ কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।হারাম টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করাও বৈধ নয়। তবে যদি না জেনে গ্রহণ করে, তাহলে ব্যবসাটি হারাম হবে না। শুধু টাকা পরিশোধ করে দিলেই ব্যবসাটি হালাল হয়ে যাবে। কিন্তু জেনেশুনে হারাম টাকা দিয়ে ব্যবসা গ্রহণ করে ব্যবসা করা বৈধ নয়।তাই একাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থঃ যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারো।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে –
بد الله بن مسعود عن أبيه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال لعن الله آكل الربا وموكله وشاهديه وكاتبه
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ এর পিতা থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, তার সাক্ষী যে হয়, আর দলিল যে লিখে তাদের সকলেরই উপর আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৩৮০৯, মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস নং-৪৯৮১)
রাসূলুলাহ (ছাঃ) বললেন,
إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّارًا إِلاَّ مَنِ اتَّقَى اللهَ وَبَرَّ وَصَدَقَ
অর্থঃ ‘ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’।
[ তিরমিযী, হা/১২১০; ইবনু মাজাহ হা/২১৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৫৮।]
ক্বিয়ামতের ময়দানে কঠিন শাস্তি হ’তে মুক্তি পেতে হ’লে আল্লাহভীতি সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাউকে সামান্যতম ঠকানোর মানসিকতা অন্তরে পোষণ করা যাবে না।সমাজে অনেক লোক আছে যারা মানুষকে ঠকায় কিন্তু সভা সমাজে ভাল মানুষ সাজে,একটি কথা মনে রাখুন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকেও যদি আপনি ভুল বুজাতে পারেন কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভুল বুজানো সম্ভব না এবং কোন কিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব না।কাজেই আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন। এবং আল্লাহ তায়ালার রাজি খুশির জন্য কাজ করুন যেমন সমাজে অনেক ভাই আছেন যারা মানুষের মুখ থেকে প্রশংসা শুনার জন্য সমাজের কাজ করেন,আপনার কাজটি অনেক ভাল কাজ বটে কাজটি যদি আল্লাহ্ তায়ালার রাজি খুশির জন্য করতেন তাহলে আল্লাহ্র কাছ থেকে পরকালে পুরুস্কার পেতেন কিন্তু মানুষের মুখ থেকে প্রশংসা শুনার জন্য কাজটি করার কারনে পরকালে কোন পুরুস্কার পাবেন না বরং এজন্য তিরুস্কার রয়েছে -এ ব্যাপারে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ -رضي الله عنه- قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: « إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ، وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّار، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ: فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ» . ( مسلم والنسائي ) صحيح
তাছাড়া মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ অর্থাৎ ‘যে মওজুদদারী করে সে পাপী’ মুসলিম হা/৪২০৬।
মিথ্যা কসম করাঃ
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশিষ্ট ছাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন,
يَا مَعْشَرَ التُّجَّارِ إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ
অর্থঃ ‘হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে’। ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৯৩।
পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সকল ব্যবসায়ীকে মিথ্যা কসম বর্জন করতে হবে। কারণ তা ইসলামে নিষিদ্ধ। আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَلِفِ فِى الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ
অর্থঃ ‘ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হতে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়’। মুসলিম, মিশকাত হা/১৬০৭, ২৭৯৩।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,‘অধিক কসম খাওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ের কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত দূর করে দেয়’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭৯৪।
মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিণতি সম্পর্কে অন্য আরেকটি হাদীছে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ
অর্থঃ ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ কিবয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আবূ যার বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত ? তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঐ ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে’। [ মুসলিম, হা/১০৫; মিশকাত হা/২৭৯৫ ]
মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ী এতই ঘৃণিত যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
জনৈক বেদুঈন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছাগীটি তিন দিরহামে বিক্রি করবে? লোকটি বলল, আল্লাহ্র কসম! বিক্রি করব না। কিন্তু সে পরে সেই মূল্যেই ছাগীটি বিক্রি করে দিল। আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে এসে উল্লেখ করলাম। তিনি আমার কথাগুলো শুনে বললেন, بَاعَ آخِرَتَهُ بِدُنْيَاهُ ‘লোকটি দুনিয়ার বিনিময়ে তার পরকালকে বিক্রি করে দিয়েছে’। সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬৪।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোন দোষ-ত্রূটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখে তা প্রকাশ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোন প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيْهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ، قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّىْ
অর্থঃ ‘একদা নবী করীম (ছাঃ) কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি ? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘তাহ’লে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়’।
[ মুসলিম; মিশকাত হা/২৮৬০]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,
اَلْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا
অর্থঃ ‘ক্রেতা বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রূটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহ’লে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে’। [ বুখারী, হা/২০৭৯; মুসলিম হা/১৫৩২]
প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ক্রয়ের ইচ্ছা না থাকলে কেবলমাত্র আসল ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী করে দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
لاَ تَنَاجَشُوْا
অর্থঃ ‘তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না’। [ বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১৫৮১]
কারণ তা ধোঁকাবাজির অন্তর্ভুক্ত, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি যত সামান্যই হোক ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তা বর্জন করা উচিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি মহৎ পেশায় নিয়োজিত লোকদের বৈশিষ্ট্য তেমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে হাসান বিন ছালিহর ক্রীতদাসী বিক্রয়ের ঘটনাটি একটি অনন্য উদাহরণ।
হাসান বিন ছালিহ একটি ক্রীতদাসী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল। তা ছিল মাত্র একবারের ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ঈমানী হৃদয় তা উল্লেখ না করে চুপ থাকতে পারল না, যদিও তাতে মূল্য কম হওয়ার আশংকা ছিল। [ ইসলামে হালাল হারামের বিধান, পৃঃ ৩৪০। ]
ওজনে কম দেয়াঃ
ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ইহ-পরকালে কল্যাণ ও মুক্তিলাভ সম্ভব হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ধ্বংস অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، اَلَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، أَلاَ يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ
অর্থঃ ‘যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরাপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সকল মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হবে’ (মুতাফ্ফিফীন ১-৫)
আল্লাহ অনত্র বলেন,
وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ
অর্থঃ ‘তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না’। (আর-রহমান ৯)
বুঝা গেল যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ওজনে কম-বেশী করা গুরুতর অপরাধ। এতে এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এক শ্রেণীর মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হয়, যা ইসলামে কাম্য নয়।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে, অবৈধ উপার্জন ও লোভ-লালসাকে সংবরণ করতে হবে। আর এটাই ইসলামের দাবী। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ইহকালে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন ও পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন!!