তাহাজ্জুদ ছলাতের পরিচয়
শাব্দিক পরিচয়ঃ
تَهَجُّدٌ শব্দটির মূল ধাতু هُجُوْدٌ (হুজূদুন) এর অর্থ হচ্ছে : রাতে ঘুম থেকে উঠা।
পারিভাষিকপরিচয়ঃ
রাত্রি বেলায় ঘুম থেকে উঠে ছলাত আদায় করাকে তাহাজ্জুদ এর ছলাত বলা হয়। তাহাজ্জুদ এর ছলাতকে ছলাতুল লাইল / ক্বিয়ামুল লাইল ও বলা হয়ে থাকে।
তাহাজ্জুদ ছালাতের ফযীলত
তাহাজ্জুদ এর ছলাত বা রাত্রির ছালাত ‘ছালাতুল লাইল’ নফল হলেও তা খুবই ফযীলতপূর্ণ।
এই ছলাতের কথা উল্লেখ করত: মহান আল্লাহ তাঁর রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেন,
(وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ، عَسَى أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوْداً)
অর্থঃ রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের ছলাত পড়। এটি তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহ্মূদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন। ( সুরা বনী-ইসরাঈল: ৭৯)
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ – قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا – نِصْفَهُ أَوِ انقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا – أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا – إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْءًا وَأَقْوَمُ قِيلًا
অর্থঃ “হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী (মুহাম্মাদ (সঃ))! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধরাত্রি কিংবা তার চাইতে অল্প। অথবা তার চাইতে বেশী। আর কুরআন তিলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে।আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করব গুরুভার বাণী। নিশ্চই রাত্রিজাগরণ প্রবৃত্তি দলনে অধিক সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অধিক অনুকূল। ” (আল-মুযযাম্মিলঃ ১-৫)
(وَعِبَادُ الرَّحْمنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الأَرْضِ هَوْناً، وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَّقِيَاماً)
অর্থঃ রহ্মানের বান্দা তারা, যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা প্রশান্তভাবে জবাব দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে। (আল-ফুরকানঃ ৬৩-৬৪)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ، رَوَاهُ مُسْلِمٌ
অর্থঃ ‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হল রাত্রির (নফল) ছালাত’।
[মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।]
তিনি আরও বলেন,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ فَيَقُوْلُ مَن يَّدْعُوْنِي فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، مَنْ يَّسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَن يَّسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ، مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ- وَفِىْ رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ عَنْهُ: فَلاَ يَزَالُ كَذَالِكَ حَتَّى يُضِيْئَ الْفَجْرُ-
অর্থঃ ‘আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব? কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? এভাবে তিনি ফজর স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত আহবান করেন’।
[মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২২৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩; মুসলিম হা/১৭৭৩।]
তাহাজ্জুদ ছলাতের সময়
তাহাজ্জুদ ছলাতের সময় শুরু হয় এশার ছলাতের পর থেকে এবং শেষ হয় ফজর ( সুবহে সাদিক ) উদয় হওয়ার সাথে সাথে। রাতের প্রথমাংশে, মধ্য রাতে এবং শেষাংশে যে কোন সময়ে তাহাজ্জুদ এর ছলাত পড়া যায়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাতের যে কোন অংশে নবী (সাঃ)-কে ছলাত পড়তে দেখতে চাইতাম, সেই সময়ই দেখতে পেতাম, তিনি ছলাত পড়ছেন। আবার রাতের যে কোন অংশে আমরা তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাইতাম, তখনই আমরা দেখতে পেতাম, তিনি ঘুমিয়ে আছেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১২৪১নং)
এ কথা স্পষ্ট যে,তাহাজ্জুদ ছলাতের সর্বোত্তম সময় হল, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
কেউ কেউ মনে করেন, ‘তাহাজ্জুদ অন্ধকারে পড়তে হয়’ বা ‘তাহাজ্জুদ পড়লে জ্বিন আসে’ অথবা ‘তাহাজ্জুদ শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়’—এসব ভুল ধারণা। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচারের মানসিকতা যেন না থাকে, এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।
তাহাজ্জুদ ছলাতের রাকাআত সংখ্যা
রাতের ছলাতের বা তাহাজ্জুদ ছলাতের কোন নির্দিষ্ট রাকআত সংখ্যা নেই। ২ রাকাআত ৪ রাকাআত ৬ রাকাআত ৮ রাকাআত যে যত রাকাআত ইচ্ছা আদায় করতে পারেন।
তবে উত্তম হল প্রত্যেক ২ রাকআতে সালাম ফিরেয়ে ৮ রাকআত পড়া। অতঃপর এক সালামে (দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক না করে) ৩ রাকআত বিত্র পড়া। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর অধিকাংশ রাতের আমল।
তাহাজ্জুদ ছলাতের ক্বিরাত
তাহাজ্জুদের ছলাত আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সূরা নেই। কুরানুল কারীম এর যে কোনো স্থান থেকে আপনার জন্য তিলাওয়াত করা সহজ সেখান থেকে তিলাওয়াত করলে তিলাওয়াত হয়ে যাবে।যেমন
এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! (সঃ) আমার এক প্রতিবেশী রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, কিন্তু ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ছাড়া অন্য কিছু পড়ে না; এটাকেই সে বারবার ফিরিয়ে পড়ে এবং এর চাইতে বেশী কিছু পড়ে না। আসলে এ ব্যক্তি তা খুবই কম মনে করল। কিন্তু নবী (সঃ) বললেন, “সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! ঐ সূরা এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমতুল্য।” ( আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী )
তবে তাহাজ্জুদ ছলাতের ক্বিরাআত লম্বা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ ছলাত হল লম্বা কিয়াম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ৪৬, ৮০০নং)
তিনি এই ছলাতে এত দীর্ঘ ক্বিয়াম করতেন যে, তার ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে বলা হল যে, আপনার তো আগে-পিছের সকল ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? (তাও আপনি এত কষ্ট করে ইবাদত করেন কেন?) তিনি বললেন, “আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২২০নং)
হুযাইফা বিন ইয়ামান বলেন, এক রাতে নবী (সাঃ)-এর সাথে ছলাত পড়লাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ্ পড়তে শুরু করলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো বা তিনি ১০০ আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করবেন। কিন্তু তিনি তা অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম হয়তো বা তিনি সূরাটিকে ২ রাকআতে পড়বেন। কিন্তু তিনি তাও অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম, তিনি হয়তো সূরাটি শেষ করে রুকূ করবেন। (কিন্তু না, তা না করে) সূরা নিসা শুরু করলেন। তাও পড়ে শেষ করলেন। তারপর সূরা আলে ইমরান ধরলেন এবং তাও পড়ে শেষ করলেন!
তাহাজ্জুদ ছলাত এর ক্বিরাত আস্তে পড়া যায় আবার জোড়েও পড়া যায়।সাহাবী গুযাইফ বিন হারেস বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) প্রথম রাতে নাপাকীর গোসল করতেন, নাকি শেষ রাতে?’ তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘কোন রাতে তিনি প্রথম ভাগে গোসল করতেন, আবার কোন কোন রাতে শেষ ভাগে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি বিত্রের ছলাত প্রথম রাত্রিতে পড়তেন, নাকি শেষ রাত্রিতে?’ তিনি বললেন, ‘কখনো তিনি প্রথম রাত্রিতে বিত্র পড়তেন, আবার কখনো শেষ রাত্রিতে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ পুনরায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি (তাহাজ্জুদের ছলাতে) সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন, নাকি নিঃশব্দে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি কখনো সশব্দে পড়তেন, আবার কখনো নিঃশব্দে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ২০৯, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ১২৬৩নং)
Leave a Comment
You must be logged in to post a comment.