তাওহীদ

মানুষের জীবনে তাওহীদ অতীব গুরত্বপুর্ণ বিষয়। তাওহীদ বিশ্বাসের কারণেই মানুষ পরকালে মুক্তি লাভ করবে। তাওহীদ সম্পর্কে জানা ও নির্ভেজাল তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়া প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক। তাওহীদের বিপরীত হল শিরক। যার কারণে মানুষের জীবনের সকল পুণ্য বিনষ্ট হয়, পূর্বের সব আমল বাতিল হয়ে যায় এবং পরকালে জাহান্নাম অবধারিত হয়। তাই শিরক থেকে সতর্ক-সাবধান হওয়া সকল মানুষের জন্য অতি জরূরী। আলোচ্য নিবন্ধে তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হল –

তাওহীদের পরিচয় :
তাওহীদ শব্দটি ‘ওয়াহদাতুন’ ধাতু হতে উৎপন্ন। যার অর্থ একক। তাওহীদ-এর আভিধানিক অর্থ একক গণ্য করা বা একত্ববাদ। পারিভাষিক অর্থ-আসমান ও যমীনসহ এর ভিতর ও বাইরের জানা-অজানা সকল সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা। তাওহীদ তিন প্রকার : (১) তাওহীদে রুবূবিয়াত (২) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (৩) তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াত। বাংলায় যাকে বলা যায়- সৃষ্টি ও প্রতিপালনে একত্ব, নাম ও গুণাবলীর একত্ব এবং ইবাদত ও উপাসনায় একত্ব।

তাওহীদের প্রকারভেদ

(১) তাওহীদে রুবূবিয়াত – এর অর্থ হল আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রূযীদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা, জীবন ও মরণদাতা প্রভৃতি হিসাবে বিশ্বাস করা। কিছু সংখ্যক নাস্তিক ও প্রকৃতিবাদী ছাড়া দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষ সকল যুগে এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনকালে মক্কার মুশরিক আরবরাও আল্লাহকে রব হিসাবে, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করত। কুরায়েশ নেতারা তাদের ছেলেদের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুল মুত্ত্বালিব ইত্যাদি রাখত।

(২) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত – এর অর্থ হল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পৃক্ত ও সনাতন বলে বিশ্বাস করা, যা বান্দার নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। সুগন্ধিকে যেমন ফুল হতে পৃথক করা যায় না, কিরণকে যেমন সূর্য হতে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, আল্লাহর গুণাবলীকে তেমনি তাঁর সত্তা হতে পৃথক ভাবা যায় না। তিনি দয়া বিহীন দয়ালু, কথা বিহীন কথক, কর্ণহীন শ্রোতা বা হস্তবিহীন দাতা নন। তিনি নিরাকার বা নির্গুণ সত্তা নন। বরং তাঁর আকার রয়েছে। কিন্তু তা কেমন তা কেউ জানে না। তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা ( শূরা ৪২/১১ )। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই ( ইখলাছ ১১২/৪ )।

লোকেরা তাঁর সম্পর্কে যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করে থাকে, সেসব থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে ( ছাফফাত ৩৭/১৮০ )। মুআত্ত্বিলাগণ আল্লাহকে নির্গুণ ও নিরাকার মনে করে শূন্য সত্তার পূজারী হয়েছে। জাহমিয়া, ক্বাদারিয়া, মুতাযিলা প্রভৃতি এদের অনেকগুলি উপদল রয়েছে। মুজাসসিমাহ ও মুশাবিবহাগণ আল্লাহকে বান্দার সদৃশ কল্পনা করে মূর্তিপূজারী হয়েছে। প্রকৃত সত্য রয়েছে এ দুইয়ের মধ্যবর্তী পথে,যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের গৃহীত পথ।

(৩) তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াত-এর অর্থ হল সর্বপ্রকার ইবাদতের জন্য আল্লাহকে একক গণ্য করা। আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা সহ চরম প্রণতি পেশ করাকে ইবাদত বলা হয়। সামগ্রিক অর্থে ইবাদত ঐসকল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কাজের নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও খুশী হন। ইলাহ সেই সত্তাকে বলা হয়, যাঁর নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করতে হয় ও যাঁকে ইবাদত করতে হয় মহববতের সাথে একনিষ্ঠভাবে ভীতিপূর্ণ সম্মান ও সর্বোত্তম শ্রদ্ধার সাথে।

মানুষের জীবনে ইবাদাত ও মুআমালাত বা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক দুটি দিক রয়েছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মিক বা রূহানী জগতটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আধ্যাত্মিক জগতের বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ তার বৈষয়িক জীবন পরিচালনা করে। এ কারণে আধ্যাত্মিক জগতকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য ইসলাম যে বিধান সমূহ প্রদান করেছে তা হল তাওক্বীফী। অর্থাৎ যার কোন নড়চড় নেই। বান্দার পক্ষ হতে সেখানে কোনরূপ রায়-ক্বিয়াস বা ইজতিহাদের অবকাশ নেই। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবহ-মানত ইত্যাদি ইবাদত সমূহের নিয়ম পদ্ধতি উক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এসব ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে প্রাপ্ত বিধান মেনে চলাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য।

অতঃপর মুআমালাত বা বৈষয়িক জীবনে মুমিন আল্লাহ প্রেরিত হুদূদ বা সীমারেখার মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। আদেশ-নিষেধ ও হালাল-হারাম-এর সীমারেখার মধ্যে থেকে যোগ্য আলেমগণ শার’য়ী মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ করবেন ও যুগ-সমস্যার সমাধান দিবেন। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন, চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি মানুষের জীবনের বিস্তীর্ণ কর্মজগত তার মুআমালাত বা বৈষয়িক জীবনের অন্তর্ভুক্ত। একজন প্রকৃত মুমিন তার আধ্যাত্মিক জীবনে যেমন আল্লাহর বিধান মেনে চলেন, তেমনি বৈষয়িক জীবনেও ইসলামী শরীআতের আনুগত্য করে থাকেন। আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ও বৈষয়িক জীবনে গায়রুল্লাহর আনুগত্য স্পষ্ট শিরক। জান্নাতপিয়াসী মুমিনকে তাই ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন হাদীছপন্থী হতে হবে, বৈষয়িক জীবনেও তেমনি শার’য়ী বিধানের আনুগত্য করে চলতে হবে। নইলে তার তাওহীদের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তাওহীদে রুবূবিয়াতকে মেনে নিলেও কাফের আরব নেতারা তাওহীদে ইবাদতকে মেনে নিতে পারেনি বলেই নবীকে অস্বীকার করেছিল।

তাওহীদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :

তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাওহীদের কারণেই মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে এবং পরকালে জান্নাত লাভে সক্ষম হবে। নিম্নে তাওহীদের গুরুত্বের কতিপয় দিক উল্লেখ করা হল –

১. মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য :
আল্লাহ মানুষকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্য তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ আমি মানুষ ও জিনকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি ( যারিয়াত ৫১/৫৬ )। আর ইবাদতের মূল তাওহীদের স্বীকৃতি।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ  হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদতে সর্বদা রত থাক, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে তোমরা সংযমী ও মুত্তাক্বী হতে পারবে ( বাক্বারাহ ২/২১ )। তিনি আরো বলেন, فَلاَ تَجْعَلُوْا للهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘তাঁর সাথে অন্য কাউকে কদাচ অংশীদার করো না, অথচ তোমরা জান   ( বাক্বারাহ ২/২২ )।

মানবজাতির সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে এক বলে জানা। কেননা আল্লাহকে এক বলে না জানা পর্যন্ত তাঁকে এক বলে মানাও যায় না। আল্লাহ বলেন,  فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَ اللهُ  অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)।

২. নবী-রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদের প্রতিষ্ঠা :
তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ মানবজাতির নিকট যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাওহীদই হচ্ছে সমস্ত রাসূলদের দাওয়াতের মূল কথা, যার দিকে তাঁরা তাঁদের উম্মতদের ডেকেছেন। আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلاَ نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَ أَنَا فَاعْبُدُونِ আর তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমরা পাঠাইনি যার প্রতি আমরা এই ওহী অবতরণ করিনি যে, আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত কর (আম্বিয়া ২১/২৫)। তিনি আরো বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতির নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূতকে পরিহার কর(নাহল ১৬/৩৬)।

৩. তাওহীদ বিশ্বাস নিরাপত্তা ও হেদায়াত লাভের মাধ্যম :
আল্লাহ বলেন,الَّذِيْنَ آمَنُواْ وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيْمَانَهُم بِظُلْمٍ أُوْلَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُوْنَ যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী (আন’আম ৬/৮২)।

তিনি আরো বলেন,এবং এ কারণেও যে, যাদেরকে জ্ঞানদান করা হয়েছে তারা যেন জানে যে, এটা তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে সত্য; অতঃপর তারা যেন এতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন এর প্রতি অনুগত হয়। আল্লাহ বিশ্বাসস্থাপনকারীকে অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করেন ( হজ্জ ২২/৫৪)।

৪. দুনিয়া ও আখিরাতে দৃঢ়তা লাভের মাধ্যম :
আল্লাহ বলেন, يُثَبِّتُ اللهُ الَّذِينَ آمَنُواْ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন’ (ইবরাহীম ১৪/২৭)।

৫. গুনাহ মাফের উপায় :
আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমরা অবশ্যই তাদের মন্দ কর্মগুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব  (আনকাবূত ২৯/৭)। তিনি আরো বলেন, وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ آمَنُواْ وَاتَّقَوْاْ لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلأدْخَلْنَاهُمْ جَنَّاتِ النَّعِيمِ আর যদি আহলে কিতাবরা বিশ্বাস স্থাপন করত এবং আল্লাহভীতি অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের মন্দ বিষয়সমূহ ক্ষমা করে দিতাম এবং তাদেরকে নিয়ামতের উদ্যানসমূহে প্রবেশ করাতাম’ (মায়েদাহ ৫/৬৫)।

৬. জান্নাত লাভের মাধ্যম :
আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَبَشِّرِ الَّذِين آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنْهَا مِن ثَمَرَةٍ رِّزْقاً قَالُواْ هَـذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِن قَبْلُ وَأُتُواْ بِهِ مُتَشَابِهاً وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

‘আর হে নবী! যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ সমূহ করেছে, তুমি তাদেরকে এমন জান্নাতের সুসংবাদ দাও, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসাবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্ত্ততঃ তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধাচারিণী রমণীকুল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫)।