হাদীসের পরিচয়
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যা বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
হাদীস বলে যা জানা যায় তা সত্যিই রাসুল (সাঃ) এর কথা কিনা তা যাচাই করে নির্ভরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিভিন্ন প্রকারে ও পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
হাদিস সম্পর্কিত পরিভাষা
মুহাদ্দিসঃ
যে ব্যক্তি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের ‘সনদ’ ও ‘মতন’ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তাঁকে মুহাদ্দিস বলে।
সনদঃ
হাদীসের মূল কথাটুকু যে সুত্র পরম্পরায় হাদীসের গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে ‘সনদ’ বলা হয়। এতে হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।
মতনঃ
হাদীসের মূল কথা বা বক্তব্য ও তার শব্দ সমষ্টিকে ‘মতন’ বলে।
রিওয়ায়াতঃ
হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে। কখনও কখনও মূল হাদীসকেও রিওয়ায়াত বলে। যেমন, এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়াত (হাদীস) আছে।
রাবীঃ
হাদীস বর্ণনাকারীকে রাবী বলা হয়।
সাহাবীঃ
যে ব্যাক্তি ঈমানের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাঁকে দেখেছেন ও তাঁর হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাঁকে দেখেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহাবী বলে।
তাবিঈঃ
সাহাবীদের ঠিক পরের প্রজন্মের কোন ব্যক্তি যিনি রাসুল (সাঃ) এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততঃপক্ষে সাহাবীকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁকে তাবিঈ বলে।
হাদীসে কুদ্সীঃ
এ ধরনের হাদীসের মূলকথা সরাসরি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং তাঁর সাথেই সংশ্লিষ্ট। যেমনঃ আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন তাঁর রাসূল (সা) কে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা জিব্রাঈল (আ) এর মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছেন এবং নাবী কারীম (সাঃ) নিজের ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন। হাদীসে কুদ্সীর বর্ণনা শুরু হয় ঠিক এইভাবেঃ “রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,……।”
মরফূ’ হাদীসঃ যে হাদীসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) রাসূলুল্লাহ্ (সা) পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ, যে হাদীসের সনদ-সূত্রে সরাসরি নাবী কারীম (সা) এর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে সেই হাদিসকে মরফূ’ হাদীস বলে।
মাওকূফ হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ, যে সনদ-সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকূফ হাদীস বলে। এই ধরনের হাদীসে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয় এবং তা সরাসরি নাবী কারীম (সা) থেকে বর্ণিত নয়।
এ ধরনের হাদীসের উদাহরণ হল ‘আলী ইবনু আবি তলিব (রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহু) এর এই কথাগুলোঃ “ভালবাসার মানুষকে ভালবাসতে গিয়ে চরমপন্থা অবলম্বন করবেন না; কারণ হতে পারে একদিন হয়ত আপনিই তাকে ঘৃণা করতে পারেন। আবার কাউকে ঘৃণা করার ক্ষেত্রেও চরমপন্থা অবলম্বন করবেন না; কারণ হতে পারে আপনিই একদিন তাকে ভালবাসতে পারেন।” [সহীহ্ আল-বুখারী; অধ্যায়ঃ আদাবুল মুফ্রাদ, হাদীস নং-৪৪৭]
মাকতূ’ হাদীসঃ
যে হাদীসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ, যে সনদ-সূত্রে কোন তাবিঈর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাকতূ’ হাদীস বলে। মাকতূ’ হাদীস “আসার” (বর্ণনা) বলেও পরিচিত।
উদাহরণস্বরূপ, মাস্রূক ইবনুল আজ্দা (রাহিমাহুল্লাহ্) এর কথাগুলো মাকতূ’ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেনঃ “আল্লাহ্কে ভয় করার মত জ্ঞানই হল যথেষ্ট জ্ঞান আর নিজের কর্ম সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করাই হল যথেষ্ট মূর্খতা বা অজ্ঞতা।”
মুত্তাসিল হাদীসঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই কোন রাবীর নাম বাদ পরেনি, তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।
মুরসাল হাদীসঃ যে হাদীসের সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবিঈ সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছে, তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
সহীহ হাদীসঃ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫ টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বা বিশুদ্ধ হাদীস বলে। শর্ত ৫ টি হল-
১) হাদীসের সকল বর্ণনাকারী বা রাবী পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমানিত। একে ‘আদালত’ বলে।
২) সকল রাবীর স্মৃতি শক্তি প্রখর অর্থাৎ ‘নির্ভুল বর্ণনা ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমানিত। একে ‘দ্বব্ত’ বলে।
৩) সনদের প্রত্যকে রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদিসটি শুনেছেন বলে প্রমানিত। একে ‘ইত্তিসাল’ বলে।
৪) হাদীসটি অন্যান্য প্রমানিত হাদীসের বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমানিত। একে ‘শুযুয মুক্তি’ বলে।
৫) হাদিসটির মধ্যে সূক্ষ্ম কোন সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমানিত। একে ‘ইল্লাত মুক্তি’ বলে।
হাসান হাদীসঃ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যেসব হাদীসে সহীহ হাদীসের ৫ টি শর্ত বিদ্যমান, কিন্তু দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ, ‘যাবতা’ বা হাদীস বর্ণনাকারীর ‘নির্ভুল বর্ণনা ক্ষমতা’ কিছুটা দুর্বল বলে বোঝা যায়, সেই হাদিসকে হাসান হাদীস বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ, যদি সনদে উল্লেখিত কোন একজন রাবীর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে এইরূপ রাবীর বর্ণিত হাদীস ‘হাসান হাদীস’ বলে গন্য।
ফিকহবিদগণ সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান নির্ধারণ করেন।
যঈফ বা দুর্বল হাদীসঃ যে হাদীসের মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলি অবিদ্যমান দেখা যায়, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে যঈফ হাদীস বলে। অর্থাৎ,
১- রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, বা
২- তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, বা
৩- সনদের মধ্যে কোন একজন রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে শোনেননি বলে প্রমানিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, বা
৪- অন্যান্য প্রমানিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া, অথবা
৫- সূক্ষ্ম কোন সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি থাকা;
ইত্যাদি যে কোন একটি বিষয় কোন হাদীসের মধ্যে থাকলে হাদিসটি যঈফ বলে গণ্য। কোন হাদিসকে ‘যঈফ’ বলে গণ্য করার অর্থ হল, হাদিসটি রাসুল (সাঃ) এর কথা নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
মাউযু হাদীস বা বানোয়াট হাদীসঃ যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে রাসুল (সাঃ) এর নামে বানোয়াট কথা সমাজে প্রচার করেছে অথবা, ইচ্ছাকৃত ভাবে হাদীসের সুত্র (সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কমবেশি করেছে বলে প্রমানিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদিসকে বানোয়াট বা মাউযু হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
গরীব হাদীসঃ যে সহীহ হাদীস কোন যুগে মাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে গরীব হাদীস বলা হয়।
Leave a Comment
You must be logged in to post a comment.