রমাদান মাসের আমল সমূহ
রমাদান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস, বেশি বেশি নেক আমলের মধ্যমে গুনাহ্ সমূহ মাফ করানোর মাস। সর্বোপরি এ মাস হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষনের মাস অর্থাৎ এমাসে আমরা নেক আমল করবো এবং সকল প্রকার গূনাহ্ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবো এবং সে অনুযায়ী বছরের বাকি ১১ মাস আমাদের জীবন পরিচালনা করবো । রমাদান মাসের আমল সমূহকে আমরা ২ ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
প্রথম ভাগঃ
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের যে সমস্ত আমল গূলো করতে আদেশ দিয়েছেন সে সমস্ত আমল গূলো যথাযথ ভাবে পালন করা।
দ্বিতীয় ভাগঃ
মহান আল্লাহ রব্বুল আমাদের যে সমস্ত আমল গূলো করতে নিষেধ করেছেন সে সমস্ত আমল গূলো পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা।
প্রথম ভাগ
১. ছিয়াম পালন করাঃ
ছিয়াম পালন করা রমাদান মাসের অন্যতম প্রধান আমল। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন।
– يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ
অর্থঃ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমদের উপর ছিয়াম ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার – নির্দিষ্ট কয়েকদিন মাত্র ……।’’ (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৩-১৮৪)
-فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُ
অর্থঃ‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে ছিয়াম পালন করে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)
আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেন,
«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৭)
২.কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করাঃ
রমাদান মাস কোরআন নাযিলের মাস। মহান আল্লাহ রব্বুল বলেন,
-شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
অর্থঃ রমাদান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কোরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যমিথ্যার পার্থক্যকারী।[ সূরা বাকারা : ১৮৫]
তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত এ মাসে কুরআন সহিহ্ শুদ্ধ ভাবে শিক্ষা করা এবং কুরআন এর অর্থ ও তাফসীর পড়ে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা।
এ কুরআন কিয়ামতের দিবসে আমাদের জন্য সুপারিকারী হবে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেন,
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ
অর্থঃ ছিয়াম এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। ছিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চারিতার্থ করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন এবং কুরআন বলবে আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেই নাই তাই তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন অতপর তাদের দুই জনেরই সুপারিশ গ্রহন করা হবে।’’ (মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬২৬, আল-মুস্তাদরাক, হাদীস নং ২০৩৬)
৩.ছিয়ামের নিয়ত করাঃ
ছিয়াম পালন করার জিন্য রাতেই নিয়্যাত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
-مَنْ لَمْ يُبَيِّتِ الصِّيَامَ مِنَ اللَّيْلِ قَبْلَ الْفَجْرفَلاَ صِيَامَ لَه
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি ফজর উদয়ের পূর্বে, রাতেই ছিয়ামর নিয়্যাত করেনা, তার ছিয়াম হবে না।’’
[সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস নং ২৩৩২]
মনে মনে এতুটুকু নিয়্যাত করাই যথেস্ট আগামী কাল ছিয়াম পালন করবো।আরবীতে কিংবা মুখে নিয়্যাত উচ্চারণ করার দরকার নেই।
৪. দেরী করে সেহেরী খাওয়াঃ
সেহেরী খাওয়া একটি বরকতময় বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ এ উম্মাতকে দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَر
অর্থঃ ‘‘আমাদের ছিয়াম ও আহলে কিতাবের ছিয়ামর মধ্যে পার্থক্য হলো সাহ্রী খাওয়া।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৪)
সেহেরী বরকতময় হওয়ার প্রমাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,
تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِى السُّحُورِ بَرَكَة
অর্থঃ‘‘তোমরা সেহেরী খাও, কেননা সেহেরীতে রয়েছে বরকত।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৩ )
দেরী করে সেহেরী খাওয়ার দলীল হল, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যায়েদ বিন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
«تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ قَامَ إِلَى الصَّلَاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ بَيْنَ الْأَذَانِ وَالسَّحُورِ قَالَ قَدْرُ خَمْسِينَ آيَةً»
অর্থঃ‘‘আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সেহেরী খেয়েছি। অত:পর তিনি ছলাতে দাঁড়ালেন।’’ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন জিজ্ঞাসা করলেন, আযান ও সেহেরীর মধ্যে কতটুকু সময়ের পার্থক্য ছিল? যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘‘পঞ্চাশটি আয়াত পরিমাণ।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২১ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৬ )
৫. তাড়াতাড়ি ইফতার করাঃ
সূর্য অস্ত যাওয়া নিশ্চিত হলে তাড়াতাড়ি ইফতার করা ছিয়ামদারের জন্য মুস্তাহাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ»
অর্থঃ‘‘মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের উপর থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অনতিবিলম্বে ইফতার করবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৬ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৮)
৬. ছিয়ামদারদের ইফতার করানোঃ
সহীহ সনদে তিরমিযী ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ إِلَّا أَنَّهُ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْء»
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোন ছিয়ামদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত ছিয়ামদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭ ও মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৭০৩৩)
৭. কিয়ামুল লাইলঃ
তারাবীহ, তাহজ্জুদ এবং রাতের যে কোন নফল ছলাত এর অন্তর্ভূক্ত। যে সকল আমলের মাধ্যমে মু’মিন ব্যক্তি রামাদান মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে, তন্মধ্যে কিয়ামুল লাইল সবচেয়ে উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ»
অর্থঃ ‘‘ফরয ছলাতের পর সর্বোত্তম ছলাত হচ্ছে রাতের ছলাত”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৮১২)
রামাদানে কিয়ামুল লাইলের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি রামাদান মাসে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় (রাতের ছলাতে) দাঁড়ায় তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৫)
৮. আল্লাহর রাস্তায় বেশী বেশী দান ও সদকা করাঃ
আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রামাদান মাসে এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা ইমাম বুখারী ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ ……. فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنْ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ»
অর্থঃ“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রামাদান মাসে যখন জিবরীল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন…..। জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন”। (সহীহ বুখারী,হাদীস নং ৩০৪৮)
৯. উমরা পালনঃ
যিনি উম্রাহ্ করার সামর্থ রাখেন তিনি উমরাহ্ পালন করবেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«فَإِنَّ عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ تَقْضِي حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِي»
অর্থঃ ‘‘রামাদান মাসে উমরা করা হজ্জের সমতুল্য’’ অথবা ‘‘আমার সাথে হজ্জ করার সমতুল্য’’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং১৬৯০ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫৬)
১০. ই’তেকাফঃ
রমাদান মাসের শেষ দশদিন ই’তেকাফে বসা অতি উত্তম ইবাদাত। শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানের প্রথম দশদিন ই’তেকাফে বসেন। এরপর লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে মাঝের দশদিন ই’তেকাফে বসেন। এরপর যখন লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশদিনে হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন থেকে তিনি শেষ দশদিন ই’তেকাফে বসতে লাগলেন। অত:পর তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ই’তেকাফে বসেন। হাদীসে এসেছে,
«اعْتَكَفَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ الْأُوَلِ مِنْ رَمَضَانَ وَاعْتَكَفْنَا مَعَهُ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي تَطْلُبُ أَمَامَكَ فَاعْتَكَفَ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ فَاعْتَكَفْنَا مَعَهُ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي تَطْلُبُ أَمَامَكَ فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْه وَسَلَّمَ خَطِيبًا صَبِيحَةَ عِشْرِينَ مِنْ رَمَضَانَ فَقَالَ مَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلْيَرْجِع….. »
অর্থঃ“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানের প্রথম দশদিন ইতেকাফ করেন। (সাহাবারা বলেন) আর আমরাও তার সাথে ই’তেকাফ করলাম। এরপর জিবরীল আসলেন এবং বললেন, যা আপনি অনুসন্ধান করছেন তা আপনার সামনে রয়েছে। এরপর তিনি মাঝের দশদিন ই’তেকাফ করলেন। (সাহাবারা বলেন) আমরাও তার সাথে ই’তেকাফ করলাম। এরপর জিবরীল আসলেন এবং বললেন, যা আপনি অনুসন্ধান করছেন তা আপনার সামনে রয়েছে। তারপর বিশ রমাদান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিলেন এবং বললেন, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ই’তেকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে…..”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৮০)
১১. রামাদানের শেষ দশ দিনে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকাঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রিতে (ছলাতে) দাঁড়ায়, তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হল”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০২)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদানের শেষ দশ রাতে নিজে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকতেন এবং পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ»
অর্থঃ ‘‘যখন রামাদানের শেষ দশদিন এসে যেত, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরনের কাপড় মজবুত করে বাঁধতেন। (অর্থাৎ দৃঢ়তার সাথে প্রস্তুতি নিতেন) এবং নিজে রাত্রে জাগতেন এবং পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২০ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৪৪)
তিনি সাহাবাদেরকেও লাইতুল ক্বদর অনুসন্ধান এ ব্যাপৃত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
«الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ فِي كُلِّ وِتْرٍ»
অর্থঃ “তোমরা শেষ দশদিনের বেজোড় রাতে এ রাত্রি তালাশ করো”। (সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯২)
১২.বেশী বেশী দো‘আ, যিকর এবং ইস্তেগফার করাঃ
রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দো‘আ, যিকর ও ইসস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রামাদান মাস দো‘আ কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়, আমরা নিম্নে বর্ণীত দূ আ’ গুলো বেশি বেশি করতে পারি।
দ্বিতীয় ভাগ
১.মিথ্যা কথা না বলাঃ
ছিয়ামদারদের উচিত তাকওয়া বিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَه»
অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি (ছিয়াম রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৪)
‘‘মিথ্যা কথা ও তদনুযায়ী কাজ’’ কথাটি দ্বারা মূলত: ছিয়াম অবস্থায় উম্মতের সকলকে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। আর‘‘আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’’ কথাটি দ্বারা ছিয়াম অসম্পূর্ণ হওয়ার, কিংবা কবুল না হওয়ার অথবা ছিয়ামর সওয়াব না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
২. অশ্লীল কথা না বলাঃ
অশ্লীল কথা না বলা , না শোনা এবং না দেখা (টিভিতে হওক মোবাইলে হউক বা অন্যান্য ডিভাইস এ হউক)।
আরেকটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
-إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِم
অর্থঃ ‘‘তোমাদের কেউ ছিয়ামর দিনে অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি ছিয়ামদার ।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
৩.ঝগড়া না করাঃ
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা খোলা হয়। মা’মার বলেন সুহাইল ব্যতিত অন্যরা বলেছেন, প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার (বান্দার) আমল পেশ করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন,যারা আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে না;তবে ঝগড়াকারী দুই ব্যক্তি ব্যতিত। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেন,এদেরকে অবকাশ দাও;যতক্ষণ না তারা মীমাংসা (সমঝোতা) করে নেয়। (মুসনাদে আহমাদ)
উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি ঝগড়ার কারণে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন এর ক্ষমা থেকে ঝগড়াকারীরা বঞ্চিত হয়। আর সিয়াম পালনকারীর সাথে যদি কেও ঝগড়া করে তাহলে সে বলবে আমি স-য়িম যা উপরোক্ত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
৪.গীবত না করাঃ
কোনো লোকের অনুপস্থিতিতে তার দোষের কথা প্রকাশ করা, তার বদনাম ও তার নিন্দা, সমালোচনার মাধ্যমে তার সুনাম খর্ব করা, লোকসমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি।
তবে মহানবী (সা.) গীবতের যে অর্থ করেছেন তা জানা থাকা উচিত। তিনি এক হাদিসে (গীবত/পরনিন্দা) ও ‘বোহতান’ (অপবাদ) এর মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেছেন, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জান, গীবত কি? সাহাবাগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন।’
তিনি বললেন, ‘গীবত হচ্ছে এই যে, তুমি নিজের ভাইয়ের কথা এমনভাবে উল্লেখ করো যে, যা সে পছন্দ করে না।’ অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বলুন, আমি যে কথাটি বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থেকে থাকে?’ তিনি বললেন, ‘এটাই তো গীবত, যা তুমি বলছো। তার মধ্যে তা থাকলেই গীবত। আর যদি যে কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে তা না থাকে তা হলে তুমি তার ওপর অপবাদ (বোহতান) আরোপ করেছ।’ (মেশকাত)।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ
অর্থঃ মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
৫.হিংসা না করাঃ
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অপরের ভালো কিছু সহ্য করতে পারেন না। অপরের ভালো দেখলে মনে মনে খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগাটাই হচ্ছে হিংসা। কেউ কেউ আবার তার নিজের চেয়ে অন্য কারও ভালো থাকা বা সুখে থাকা মেনে নিতে পারেন না। মনে মনে হিংসা করেন। কিন্তু এমন হিংসা করা মূলত এক ধরনের পাপ ও ভয়ানক ব্যাধি। হিংসা মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এই হিংসার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআনের শক্ত অবস্থান সুরা ‘ফালাক’- ‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই, যখন সে হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক :৫)
এ প্রসঙ্গে “রাসূল (সঃ) বলেছেন : তোমরা হিংসা হতে বিরত থাক। কেননা হিংসা মানুষের সত্কর্মগুলোকে খেয়ে ফেলে যেমনিভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে” (আবূ দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৪২৭, হাদীস নং-৪৯০৫)।