জুমআ’র দিনের সুন্নত সমূহ

জুমআ’র দিনের ফযীলত

জুমআ’র দিন সপ্তাহের সব দিনের চাইতে শ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জান্নাত দান করা হয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যার উপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমআ’র দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে জান্নাত থেকে। (এই দিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়েছে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে এই দিনেই। আর কিয়ামত সংঘটিত হবে এই দিনেই।”(মুসলিম, মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে হিব্বান, সহীহ, জামে ৩৩৩৪নং)

মহানবী (সঃ) আর ও বলেন,

এই দিনে বা তার রাতে কেউ মারা গেলে কবরের আযাব থেকে রেহাই পাবে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে মুসলিম জুমআ’র দিন অথবা রাতে মারা যায়,আল্লাহ তাকে কবরের ফিতনা থেকে বাচান।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, জামে ৫৭৭৩)

এই বরকতময় দিনটি আমরা কিভাবে পালন করবো নিম্নে আলোচনা করা হল।

জুমআ’র দিনের সুন্নাত আমল সমূহঃ

১। সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া। 

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন নাপাকীর গোসলের মত গোসল করল। অতঃপর প্রথম সময়ে (মসজিদে গিয়ে) উপস্থিত হল, সে যেন এক উষ্ট্রী কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় সময়ে উপস্থিত হল, সে যেন একটি গাভী কুরবানী করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি শিং-বিশিষ্ট মেষ কুরবানী করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি মুরগী দান করল। আর যে ব্যক্তি পঞ্চম সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি ডিম দান করল। অতঃপর যখন ইমাম (খুতবাদানের জন্য) বের হয়ে যান (মিম্বরে চড়েন), তখন ফিরিশ্‌তাগণ (হাজরী খাতা গু টিয়ে) যিক্‌র (খুতবা) শুনতে উপস্থিত হন।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী ৮৮১, মুসলিম, সহীহ ৮৫০, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান)

২। জুমআ’র জন্য প্রস্তুতিস্বরুপ দেহের দুর্গন্ধ দূর করা,সে জন্য গোসল করা,আতর ব্যবহার করা :

মহানবী (সাঃ) বলেন,“যে ব্যক্তি জুমুআহ পড়তে আসবে,সে যেন গোসল করে আসে।” (বুখারী,মুসলিম )

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন গোসল করবে, যথাসাধ্য পবিত্রতা অর্জন করবে, তেল ব্যবহার করবে, অথবা নিজ পরিবারের সুগন্ধি নিয়ে ব্যবহার করবে, অতঃপর (জুমআ’র জন্য) বের হয়ে (মসজিদে) দুই মুছল্লীর মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করবে না (কাতার চিরবে না),অতঃপর যতটা তার ভাগ্যে লিখা আছে ততটা ছলাত পড়বে, অতঃপর ইমাম খুতবা দিলে চুপ থাকবে,সে ব্যক্তির এই জুমআ’র থেকে আগামী জুমআ’র পর্যন্ত কৃত পাপ মাফ হয়ে যাবে।” (বুখারী, মিশকাত ১৩৮১নং)

৩। দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করা :

দাঁতন ব্রাশ করে দাঁত ও মুখের দুর্গন্ধ দূরীভূত করে নেওয়া জুমআ’র পূর্বে একটি করণীয় কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন,“প্রত্যেক সাবালকের জন্য জুমআ’র দিন গোসল করা, মিসওয়াক করা এবং যথাসাধ্য সুগন্ধি ব্যবহার করা কর্তব্য।” (মুসলিমঃ ৮৪৬নং)

৪। সুন্দর পোশাক পরিধান করা :

মহানবী (সাঃ) বলেন ‘যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন গোসল করে,খোশবূ থাকলে তা ব্যবহার করে এবং তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরিধান করে,অতঃপর স্থিরতার সাথে মসজিদে আসে,অতঃপর ইচ্ছামত ছলাত পড়ে এবং কাউকে কষ্ট দেয় না,অতঃপর ইমাম বের হলে ছলাত শেষ হওয়া পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকে,সে ব্যক্তির এ কাজ দুই জুমআ’র মাঝে কৃত গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, মিশকাত ১৩৮৭নং)

জুমআ’র জন্য সাধারণ আটপৌরে পোশাক বা কাজের কাপড় ছাড়া পৃথক তোলা পোশাক ও কাপড় পরা বাঞ্ছনীয়। যেহেতু জুমআ’র দিন মুসলিমদের সমাবেশের দিন। আর এ দিনে সাজসজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যাতে অপরের কাছে কেউ ঘৃণার পাত্র না হয়ে যায়। অথবা তার অপরিচ্ছন্নতায় কেউ কষ্ট না পায়।

একদা খুতবার মাঝে মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের পরিশ্রমের কাপড় ছাড়া জুমআ’র জন্য অন্য এক জোড়া কাপড় থাকলে কি অসুবিধা আছে?” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৯৫-১০৯৬নং)

৫। পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া।

এর জন্য মর্যাদাও আছে পৃথক। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন,“যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন (মাথা) ধৌত করে ও যথা নিয়মে গোসল করে,সকাল-সকাল ও আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হয়,সওয়ার (কোন বাহন) না হয়ে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, ইমামের কাছাকাছি বসে মনোযোগ সহকারে (খোতবা) শ্রবণ করে,এবং কোন অসার ক্রিয়া-কলাপ করে না,সে ব্যক্তির প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বৎসরের নেক আমল ও তার (সারা বছরের) ছওম ও ছলাতের সওয়াব লাভ হয়!” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৬৮৭ নং)

প্রকাশ থাকে যে,যে ব্যক্তি গাড়ি করে জুমুআহ পড়তে আসে,তার এ সওয়াব লাভ হয় না। বলা বাহুল্য, যে বাসা থেকে ১০০ কদম পায়ে হেঁটে জামে মসজিদে পৌঁছবে,তার আমল-নামায় ১০০ বছরের ছওম-ছলাতের সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে;যাতে একটি গোনাহও থাকবে না। আর তা এখানেই শেষ নয়। এইভাবে সে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ এবং প্রতি বছরে প্রায় ৫২০০ বছরের ছলাত –ছওম এর সওয়াব অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ। আর এ হল মুসলিম বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।

(ذلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَّشَاءُ، وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْم)

৬। মসজিদে যেয়ে খেল তামাসা না করা কথা না বলা।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জুমআ’র সালাতে তিন ধরনের লোক হাজির হয়।
(ক) এক ধরনের লোক আছে যারা মসজিদে প্রবেশের পর তামাশা করে,তারা বিনিময়ে তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না।
(খ) দ্বিতীয় আরেক ধরনের লোক আছে যারা জুম’আয় হাজির হয় সেখানে দু’আ মুনাজাত করে,ফলে আল্লাহ যাকে চান তাকে কিছু দেন আর যাকে ইচ্ছা দেন না।
(গ) তৃতীয় প্রকার লোক হল যারা জুমআ’য় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনে, কারও ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে আগায় না,কাউকে কষ্ট দেয় না, তার দুই জুমআ’র মধ্যবর্তী ৭ দিন সহ আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ খাতা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দেন।” (আবু দাউদঃ ১১১৩)

৭। সূরা কাহ্‌ফ পাঠ  করা:

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন,“যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন সূরা কাহ্‌ফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমআ’র মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।”(নাসাঈ, সুনান, বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৭৩৫ নং)

অন্য বর্ণনায় আছে,“যে ব্যক্তি জুমআ’র দিন সূরা কাহ্‌ফ পাঠ করবে তার জন্য তার ও কা’বা শরীফের মধ্যবর্তী জ্যোতির্ময় হবে।” (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, জামে ৬৪৭১নং)

উল্লেখ্য যে,জুমআ’র সময় মসজিদে এই সূরা তেলাওয়াত করলে এমনভাবে তেলাওয়াত করতে হবে,যাতে অপরের ডিষ্টার্ব না হয়।

জ্ঞাতব্য যে, এ দিনে সূরা দুখান পড়ার হাদীস সহীহ নয়। (যইফ জামে ৫৭৬৭, ৫৭৬৮নং) যেমন আলে ইমরান সূরা পাঠ করার হাদীসটি জাল। (যইফ জামে ৫৭৫৯নং)

তদনুরুপ জুমআ’র ছলাত পড়ে ৭ বার সূরা ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক, নাস পড়ে অযীফা করার হাদীসদ্বয়ের ১টি জাল এবং অপরটি দুর্বল হাদীস। (যইফ জামে ৫৭৫৮, ৫৭৬৪, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৪৬৩০নং) সুতরাং এমন অযীফা পাঠ বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ১২২, ৩২৬পৃ:)

৮। বেশী বেশী দরুদ পাঠ :

জুমআ’র রাতে (বৃহ্‌স্পতিবার দিবাগত রাতে) ও (জুমআ’র ) দিনে প্রিয়তম হাবীব মহানবী (সাঃ)-এর শানে অধিকাধিক দরুদ পাঠ করা কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল, জুমআ’র দিন। এই দিনে তোমরা আমার প্রতি দরুদ পাঠ কর। যেহেতু তোমাদের দরুদ আমার উপর পেশ করা হয়ে থাকে। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫৩১নং)

তিনি আরো বলেন, “জুমআ’র রাতে ও দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরুদ পাঠ কর। আর যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০ বার রহ্‌মত বর্ষণ করবেন।” (বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪০৭নং)

৯। জুমআ’র দিন বেশি বেশি দু’আ করা।

এই দিনে এমন একটি সময় আছে, যাতে দুআ কবুল হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন,“জুমআ’র দিনে এমন একটি (সামান্য) মুহূর্ত আছে,যদি কোন মুসলিম বান্দা ছলাত পড়া অবস্থায় তা পায় এবং আল্লাহর নিকট কোন মঙ্গল প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে তা দিয়ে থাকেন।”(বুখারী ৯৩৫নং,মুসলিম,মিশকাত ১৩৫৭নং)

এই মুহূর্তের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে,তা হল ইমামের মিম্বরে বসা থেকে নিয়ে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়। (মুসলিম, মিশকাত ১৩৫৮নং) অথবা তা হল আসরের পর যে কোন একটি সময়। অবশ্য এ প্রসঙ্গে আরো অন্য সময়ের কথাও অনেকে বলেছেন। (যাদুল মাআদ ইবনুল কাইয়েম ১/৩৮৯-৩৯০)

১০। জুমআ’র প্রথম রাকআতে সূরা সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা দাহ্‌র (ইনসান) পাঠ করা। উভয় সূরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করাই সুন্নত। প্রত্যেক সূরার কিছু করে অংশ পড়া সুন্নত নয়।

Dawa Guide

Dawa Guide

Leave a Comment